Tuesday, 7 November 2017

শুকতারা গো নিওনা বিদায়

১৯৪৪ সাল। ঢাকা থেকে কলকাতা এসেছেন উৎপলা ঘোষ। গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তীর পরিচালনায় রেকর্ডও হয়েছে। রেকর্ড বেরোতেই সাড়া পড়ে গেল! উৎপলা তখন স্কটিশ চার্চ কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কলেজ থেকে ট্রামে বাড়ি ফিরছেন একদিন - হঠাৎ দেখা, গুরুভাই নিখিল সেনের সঙ্গে। উৎপলাকে দেখেই উচ্ছসিত হয়ে তিনি বলে উঠলেন - তোমার গান তো হিট হইসে! অবাক উৎপলা - হিট মানে কী, নিখিলদা?

- মানে, খুব বিক্রি হইতাসে।

সেই প্রথম উৎপলা জানলেন 'হিট'-এর মানে আর মান! মনে নিশ্চয়ই রেখেছিলেন আজীবন...  কালে, এই উৎপলা ঘোষই হয়েছিলেন খ্যাতনাম্নী গায়িকা উৎপলা সেন।

১৯২৪ সালের ১২ই মার্চ, ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন উৎপলা। পিতামহ রায়বাহাদুর যোগেশ ঘোষ নাতনির সুন্দর মুখশ্রী দেখে আদর করে রেখেছিলেন 'উৎপলা' নাম। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার ঘোষ। মা হিরণবালা দেবী ছিলেন আনন্দময়ী মা'র অষ্টসখীর এক সখী। হারমোনিয়াম, সেতার, এস্রাজ ও বংশীবাদনে তিনি ছিলেন অনন্যা। গাইতেন ভক্তিগীতিও। আত্মজা উৎপলাকে গানের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিলেন হিরণবালা দেবী স্বয়ং। কিছুটা বড় হলে খগেশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে তালিম নিতে শুরু করেন উৎপলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় একাধিক বিষয়ে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। তিরিশের দশকের শেষদিকের কথা। এরপর, ১৯৩৯ সালে ঢাকা বেতারকেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী হিসাবে যোগ দেন উৎপলা। প্রথম যে গানটি গেয়েছিলেন, সেটি ছিল মা হিরণবালা দেবীর শেখানো। শুধু গান নয়, অভিনয়, আবৃত্তিও করতেন ঢাকা রেডিওতে। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রপ্রয়াণের দিবসে 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'-এর আবৃত্তি প্রচারিত হয়েছিল কিশোরী উৎপলার কণ্ঠে।

স্ত্রী হিরণবালার সঙ্গীতপ্রতিভা বিকাশের কথা, সে যুগে দাঁড়িয়ে যেমন ভাবতে পারেন নি রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার, তেমনি প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে পারেন নি মেয়ে উৎপলার বাইরে গান গাওয়া। এমনকি, উৎপলা যে স্কুলে পড়তেন, সে স্কুল থেকেও গান গাওয়ার জন্য বিতাড়িত হয়েছিলেন উৎপলা। পরে যখন 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় ওঁর গানের ভূয়সী প্রশংসা প্রকাশিত হয়, যেমন গর্ববোধ করেছিলেন রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার, তেমনি উৎপলাকে সাদরে স্কুল কর্তৃপক্ষ ডেকে নিয়েছিল। ঢাকা রেডিওতে সে যুগে আধুনিক গানের প্রচলন ছিল না। চল্লিশের দশকের গোড়ায়, ঢাকা বেতারে আধুনিক গানের নতুন স্রোত এনেছিলেন ফরিদপুর নিবাসী বিখ্যাত গায়ক সুরকার সুধীরলাল চক্রবর্তী। ১৯৪০ সালে, এক সঙ্গীতালেখ্যর পরিচালনা সূত্রে সুধীরলাল সঙ্গে পরিচয় হয় উৎপলার। রেডিওশিল্পী সুকণ্ঠী উৎপলা, স্বভাবতই পড়েন সুধীরলালের নজরে। সেই থেকে উৎপলাকে ছাত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর সুশিষ্য সুধীরলাল। ইতিমধ্যে রেকর্ডসঙ্গীতজগতেও সুধীরলাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ১৯৩৯ সাল থেকেই তিনি হয়েছেন হিন্দুস্থান রেকর্ডসের নিয়মিত শিল্পী। সুধীরলাল চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণাতেই, ১৯৪২ সালে উৎপলার কলকাতায় আসা। ১৯৪৩ সালে উৎপলাও যোগ দেন হিন্দুস্থান রেকর্ডস কোম্পানিতে। সে বছর দুর্গা সেনের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় ওঁর প্রথম রেকর্ড, যার একপিঠে ছিল 'দূরে গেলে মনে রবে না জানি', ও অন্যপিঠে 'প্রিয় এই কি তোমার শেষ গান' - দুটি গানেরই রচয়িতা ছিলেন বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ী। ১৯৪৪ সালে, গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে 'এক হাতে মোর পূজার থালা' গেয়ে শ্রোতাদের নজর কাড়েন শিল্পী। সেই ছিল ওঁর প্রথম 'হিট' গান!


উৎপলা সেন

১৯৪৪ সালেই কলকাতা বেতারকেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী হিসাবে স্বীকৃতি পান উৎপলাঢাকা থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করার পর, সে বছরই, প্রথম 'হিট' রেকর্ড বেরোনোর সাথে সাথেই স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন তিনি। থাকতেন ডান্ডাস কন্যাবাসে। ততদিনে উৎপলা ব্যস্ত শিল্পী। রেডিওতে গান গাইছেন নিয়মিত, মাঝেমধ্যেই পড়ছে অনুষ্ঠানে ডাক। তখন গীত, গজল, ভজন আর ভক্তিগীতিই বেশি গাইতেন শিল্পী। আনন্দময়ী মা'র শিষ্যা, মা হিরণবালার কাছে ততদিনে শিখে গেছেন 'হরিনাম লিখে দিও অঙ্গে', 'জাগো রে জাগো রে মন'-এর মতো অপূর্ব সব ভক্তিগীতি। কলেজে পড়তে পড়তেই প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ পান উৎপলা। গুরু সুধীরলালই ওঁকে নিয়ে গেছিলেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। পঙ্কজকুমার মল্লিক তখন সঙ্গীত পরিচালনা করছেন 'মেরি বেহেন' নামক হিন্দি ছবিতে। কলকাতায় নবাগতা বাঙাল মেয়েটিকে দেখলেন। সুধীরলালের উপরও যথেষ্ট ভরসা ওঁর। তার উপর সেই মেয়ে ইতিমধ্যে রেকর্ডেও গেয়ে ফেলেছে। উৎপলা সুযোগ পেয়ে গেলেন প্লেব্যাকের। কুন্দনলাল সায়গল আর সুপ্রভা সরকারের গানের পাশাপাশি ছবিতে স্থান করে নিল কিশোরী উৎপলার 'ম্যায় ইন ফুলোঁ সঙ্গ ডোলুঁ রে' গানটি। আদর করে উৎপলাকে পঙ্কজ মল্লিক নাম দিয়েছিলেন 'মৃণাল'।   

রন্ধনপটীয়সী ছিলেন এই মৃণাল। রান্না করতেও ভালোবাসতেন। একবার বেলা দে''মহিলা মহল'-'ডাব চিংড়ি', 'ভাপা ইলিশ' রান্নাও শিখিয়েছিলেন তিনি। গুরু সুধীরলাল বাড়ি যেদিন যেতেন, পৌঁছে যেতেন একদম সকালবেলা। সুধীরলাল তখন বলতেন, উৎপলা, আমার বিড়ালগুলোর জন্য একটু রান্না করে দাও না! সযত্নে রান্না করতেন বাধ্য ছাত্রী। আসলে তিনিও যে পশুপাখিদের বড় ভালোবাসতেন! রান্না করে বিড়ালদের খাওয়াতে খাওয়াতে দুপুর হয়ে যেত। সুধীরলাল জিরিয়ে নিতেন খানিক। তারপর শুরু হত গানের ক্লাস।

স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময়টা উৎপলার জীবনের খুব আনন্দময় সময়। মিশুকে উৎপলার ছিল অনেক বন্ধু। কলেজে যেমন, তেমনি কন্যাবাসে। তাদের সঙ্গে মহানন্দে দিন কাটাতেন উৎপলা। এমনি সময় বসন্তের দূত হয়ে ওঁর জীবনে আসেন সতীন্দ্রকুমার সেন। সে সময়ে কন্যাবাসের দরজায় মাঝেমধ্যেই আসত শ্রী সেনের গাড়ি। সখীসহ উৎপলাকে নিয়ে যেতেন লং ড্রাইভে, কখনও বা কোনো ভালো রেস্তোরায়। খাওয়াতে যেমন ভালোবাসতেন, খেতেও তেমনি ভালোবাসতেন উৎপলা। ১৯৪৫ সালে সতীন্দ্রকুমারের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন উৎপলা। আই এ পরীক্ষায় আর তাঁর বসা হয়নি - তখন তিনি সাংসারিক কাজে মহাব্যস্ত। কিন্তু গানের রেওয়াজে কোনও ছেদ ঘটেনি উৎপলা সেনের। বন্ধ হয়নি গুরুর বাড়ী যাওয়াও।  বিবাহ-পরবর্তী জীবনে হিন্দুস্থান কোম্পানি থেকে নিয়মিত রেকর্ড প্রকাশ হয়েছে শিল্পীর। একে একে প্রকাশ পেয়েছে 'চলে যাওয়া নহে ভুলে যাওয়া', 'যদি ভুল ভেঙে যায়', 'প্রিয় তোমার আমার মিলন শুধু', 'প্রথম মিলনে তোমার প্রথম গান', 'গানের বলাকা ভেসে যায় প্রিয়', 'নয়নে ঘনালো শ্রাবণের ঘর', প্রভৃতি গান। পাশাপাশি, 'পথের দাবি', 'রাত্রি', 'ধাত্রীদেবতা', 'সাহারা', 'কালো ঘোড়া', 'মায়ের ডাক', 'অঞ্জনগড়', প্রভৃতি ছবিতে শোনা গেছে ওঁর গান। ১৯৪৯ সালটি শিল্পী উৎপলার জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনুপম ঘটকের পরিচালনায় সে বছর হিন্দুস্থান রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হয় আনন্দময়ী মাতা আশ্রমের শ্রী অভয় ব্রহ্মচারী রচিত 'হরিনাম লিখে দিও অঙ্গে', যা শিল্পীর মধুকন্ঠে ভক্তিরসের বন্যা বইয়ে দেয়। এ গান এমনি বিখ্যাত হয়, যে এর ইংরাজি তর্জমা কানাডা রেডিও থেকে প্রচারিত হয়। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, উর্দু ভাষায় গান গাইতেন উৎপলা। রেডিওতে তো বটেই, রেকর্ডেও হিন্দি, উর্দু গীত, গজল গেয়েছেন তিনি

গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে রেকর্ডে উনিশটি আধুনিক গান গেয়েছিলেন উৎপলা সেন। তার বেশিরভাগই, চল্লিশ এর দশকে। ১৯৫২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ডস কোম্পানিতে উৎপলা শেষ যে রেকর্ডটি করেন, তাতে তিনি কণ্ঠ মেলান গুরু সুধীরলাল সঙ্গে। গানদুটি ছিল, 'কেন গো ঝরা ফুলে' আর 'যদি নভে ওঠে চাঁদ'সে বছরই বিশ্ববিখ্যাত হিস্ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানিতে যোগদান করেন শিল্পী। সেই কোম্পানিতেও প্রথম দুটি গান করেন গুরুর সুরে। গানদুটি ছিল, 'এলো কি শাওন' 'যদি জাগে শুকতারা'১৯৫২ সালের ২০শে এপ্রিল, মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে পারলোকগমন করেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। গুরুর মৃত্যুতে আকুলা উৎপলা স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন দুটি পংক্তি,

"শুধু তব স্মৃতি নয়, নহে শুধু সুরের সম্ভার,
সমস্ত জড়ায়ে তুমি দাঁড়ায়েছে হৃদয়ে আমার।"

এই পঞ্চাশের গোড়ায় একবার এক জলসায় গাইতে এসেছেন লতা মঙ্গেশকর। সঙ্গে গাইবেন বাংলার অন্যান্য শিল্পীরাও। কিন্তু লতা স্টেজ ছাড়ার পর আর কারো সাহস হয়না গাইতে উঠবার। এমন সময় সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে স্টেজ ওঠার জন্য রাজি করান উৎপলা সেন। সেদিনের জলসায় সতীনাথের কণ্ঠ মধু ঝরায়। করতালিতে ভরে যায় প্রেক্ষাগৃহ। উৎপলার এই সহযোগিতা কোনোদিন ভোলেন নি সতীনাথ। সুধীরলাল চক্রবর্তীর প্রয়াণের পর উৎপলা সেন সঙ্গীতশিক্ষা শুরু করেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। এরপর, পঞ্চাশ, ষাটের দশক জুড়ে সতীনাথের সুরে নিয়মিত গান গেয়েছেন উৎপলা। এর শুরু সম্ভবত হয়েছিল 'হরিলক্ষ্মী' ছবির 'যাবার বেলার দিলাম তোমায় এই মালা' গানের মধ্য দিয়ে। তারপর একে একে এসেছে 'ভাবি শোনাবো না গান', 'ঝিকমিক জোনাকির দীপ জ্বলে শিয়রে', 'বেদনার মতো কী আছে মধুর আর', 'দোলা দিয়ে যায় কে', 'এমন লগন যেন চলে না যায়', 'ঝুম্কোলতার বনে', প্রাণে দোলা জাগানো আরও কত গান! উৎপলার কণ্ঠটি শুনেই যেন মনে হতো সতীনাথের সুরে গান গাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত! না, আর কোনও শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত গান এতো গান নি, যত গেয়েছেন উৎপলা সেন।


উৎপলা সেন ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায় 

উৎপলা, সতীনাথ একত্রে গান গেয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে - বেতারে, নানা জলসায়। দিল্লি, লখনৌ, পাটনা, এলাহাবাদ, জলন্ধর, কটক, শিলঙ, গৌহাটি, প্রভৃতি বেতারকেন্দ্রে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন দুজনেই। এলাহাবাদে একত্রে গান গেয়ে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন সতীনাথ-উৎপলা। এমনি সব অনুষ্ঠান ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরা। একবার কাশ্মীরে জাওয়ানদের গান শোনাতে গেছেন ওঁরা, এদিকে হাউসবোটে উৎপলার ধুম জ্বর। কোনোমতেই শরীর ঠিক হচ্ছেনা, গলা গেছে বুজে। এমন সময় বোটে এলেন বেগম আখতার। তালমিছরি, লবঙ্গ, গোলমরিচ জলে ফেলে ফুটিয়ে, বারে বারে সেটা খাওয়াতে লাগলেন। চলল জলপটি দেওয়া। সারা রাত জেগে প্রহরে প্রহরে নমাজ পড়লেন। ভোরের দিকে জ্বর নামল উৎপলার, গলার স্বরও ফিরে এলো। তখন বেগমসাহেবার ছুটি। আর একবার রেডক্রসের অনুষ্ঠানে উৎপলা গেছেন পুরী। শুনলেন পুরীর রাজাও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। মনে জেদ চাপল, রাজাকে উড়িয়া গান শোনাবেন। কিন্তু উড়িয়া গান শেখাবে কে! হঠাৎ মনে হল, যে বৃদ্ধা হোটেলের ঘরে ঘরে গিয়ে শাঁখ আর কটকী শাড়ি বিক্রি করেন, তাঁর তো উড়িয়া গান জানা থাকবে! যেমন ভাবা তেমন কাজ! সেই বৃদ্ধাকে ডেকে নিয়ে শিখে নিলেন উড়িয়া গান। রাজামশাইকে শোনালেন, 'ন জিবি মু যমুনা জিবাকু কহোনা' - রাজা শুনে অবাক!

১৯৬৫ সালের ১৩ই নভেম্বর, প্রয়াত হন উৎপলা সেনের স্বামী সতীন্দ্রকুমার। তখন পারিবারিক ও সামাজিক সমস্ত আপত্তির বাধা অতিক্রম করে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সঙ্গীতসঙ্গী উৎপলা সেন ও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। কালীঘাটে যেদিন দুজনের বিয়ে হল, সে ছিল এক রবিবার। মনের ভুলে বাড়িতে বিয়ের মালা ফেলে গেছিলেন সতীনাথ। উৎপলার তাতে কী অভিমান! ১৯৬৮ সাল। সতীনাথের রেকর্ড বিক্রি তখন তুঙ্গে, তুলনায় উৎপলার বিক্রি কম। এমন সময় এইচএমভি জানিয়ে দিল, এতকালের শিল্পী উৎপলা সেনের গান রেকর্ড করতে তারা আর আগ্রহী নন। আহত হলেন সতীনাথ। জিজ্ঞাসা করে জানা গেলো, সতীনাথের গান রেকর্ডে এইচএমভির কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সহৃদয় সতীনাথ উৎপলার এই অপমান মানতে পারলেন না। এইচএমভি ছেড়ে দিয়ে দুজনে যুক্ত হলেন মেগাফোন কোম্পানির সঙ্গে। মেগাফোনের কমল ঘোষ সানন্দে আহ্বান জানালেন শিল্পীদম্পতিকে। মেগাফোনে উৎপলা প্রথম রেকর্ড করলেন ১৯৬৯-এর পুজোয়, 'আমি তোমার কাছে বারেবারে নতুন হতে চাই' - সুরকারের দায়িত্ব পালন করলেন সতীনাথ-উৎপলার দীর্ঘদিনের শুভাকাঙ্খী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মেগাফোনে উৎপলার কণ্ঠে প্রকাশিত হল আরও অনেক গান, সত্তর-আশির দশক জুড়ে। একে একে হিট হল 'পাখিদের ওই পাঠশালাতে', 'কিংশুক ফুল হিংসুক ভারী', 'আমরা দুজনে শুধু দুজনার', 'দুখের দিনে কেউ তো থাকেনা', 'ডুবে গেলো চাঁদ মেঘের আড়ালে', ইত্যাদি গান।

সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে উৎপলা সেন ছিলেন আদরের রোশনি। রোশনি খেয়ালি, আর সতীনাথ আত্মভোলা। দুইয়ের জুটি ছিল অসম্ভব সুন্দর। প্রতি রবিবার একসঙ্গে যেতেন সিনেমা দেখতে। একবার সিনেমা হলে বিপত্তি। সেজেগুজে উৎপলা বসে আছেন নিজের সিটে, পাশের সিটে মাফলার গলায় সতীনাথ। হঠাৎ দেখেন বারেবারে, খানিক্ষন পর পর কে যেন পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছে। একী! বিরক্ত হয়ে উৎপলা স্বামীকে বললেন, পরের বার সুড়সুড়ি দিলেই আমি তোমায় চিমটি কাটবো, আর তুমি লোকটাকে ধরবে! কিছুক্ষন পর যথারীতি আবার সুড়সুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সতীনাথকে উৎপলার চিমটি। ওমা! উৎপলা দেখেন সতীনাথ লোকটাকে না ধরে হেসে উঠেছেন! পাশ ফিরে দেখেন পিছনের সিটে ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ! এতক্ষন মজা করছিলেন উৎপলার সঙ্গে!

আত্মভোলা হলেও সতীনাথ ছিলেন স্নেহময় পিতা। উৎপলার পিতৃহারা যুবক পুত্র আশীষকে চোখে হারাতেন তিনি। চেয়েছিলেন, একটা ফুটফুটে মেয়ে হোক ওঁদের। কিন্তু তাতে যদি আশীষ আঘাত পায়! তাই পুতুল-কন্যা গার্গীকে নিয়ে থাকতেন সতীনাথ। কাপড়ের গার্গীই ছিল সতীনাথের মেয়ে। দিনের বেলা সে থাকত আলমারিতে। রাতে শুতে যাবার আগে গার্গীকে আলমারি থেকে নামিয়ে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, চুল আঁচড়ে, আবার ফিরিয়ে দিতেন তার আলমারি-বিছানায়। অভিমানী উৎপলার এক বার সহ্য হয়নি গার্গীর প্রতি এই আদর - তুমি কেবলই তো গার্গীকে নিয়ে আছ! আমার দিকে ফিরেও তাকাও না! ছিঁড়ে কুটি কুটি করে বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন গার্গীকে। গার্গীকে হারিয়েও আদরের রোশনীকে আঘাত করতে পারেন নি মরমী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।


১৯৯১ সাল। উৎপলার ইন্টেস্টিনাল ভলভুলাস ধরা পড়ল। অপারেশনও হল। ওই সময় থেকেই খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে  হার্টের সমস্যা দেখা দিল সতীনাথের। তবু কাউকে বুঝতে দিতেন না শরীরের কষ্ট। একদিন সকালে বাজার থেকে ফিরেছেন। হঠাৎ অনুভব করেন বুকে অসহ্য বুকে ব্যথা।  সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে ভর্তি করা হয় পিজি-তে। দিনটা ছিল  ১৯৯২-এর ১৩ ডিসেম্বর। সেদিনই সন্ধ্যেবেলা আদরের রোশনীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। বড় একা হয়ে পড়েছিলেন উৎপলা সেন, সতীনাথের প্রয়াণের পর থেকে। ইতিমধ্যে উৎপলার ক্যান্সার ধরা পরে। দুবার অপারেশন হয়। শেষরক্ষা আর হয়নি। ২০০৫ সালের ১৩ই মে সুরলোকে গমন করেন উৎপলা সেন। শেষজীবনের এক সাক্ষাৎকারে সে সময়কার এক গল্প শুনিয়েছিলেন উৎপলা। তখন তিনি ঘোরতর অসুস্থ। অথচ ছেলে আশীষ তখন বাইরে। ডাক্তার বিমলেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছে গেছেন অস্ত্রোপচার করতে। গিয়ে করুণভাবে বললেন - ডাক্তারবাবু, আমি এখনই আপনার ভিসিট দিতে পারবোনা। আমার ছেলে বাইরে। ডাক্তার মুখোপাধ্যায় বললেন, না - তা হতেই পারেনা। ভিসিট না দিলে আমি কোনোমতেই অপারেশন করবো না। উৎপলা প্রায় করুণমুখে ফিরে যাবেন, এমন সময় তিনি ডেকে বললেন, কী? আমার ভিসিটস্বরূপ 'শুকতারা গো নিওনা বিদায়' গানটা শোনাবেন না? চোখ জলে ভরে উঠেছিল উৎপলা সেনের।

Monday, 21 August 2017

কৃষ্ণচূড়ার স্বপ্নঝরা

রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে শুরু হয়েছিল সঙ্গীতজীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়। পাইওনিয়ার কোম্পানি থেকে রেকর্ড করেছিলেন, 'কে বলে 'যাও যাও' আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া' - স্যাম্পল রেকর্ড পৌঁছালো শান্তিনিকেতনে, কবির হাতে। সে গান শুনে, তিনি অনুমোদন তো করলেনই, সঙ্গে পাঠালেন আশীর্বাণী। কুমারী সুপ্রীতি মজুমদারের একক কন্ঠে প্রথম প্রকাশিত হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড। তখন ১৯৪১। সে বছরই রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ হল, কিশোরী শিল্পীর কন্ঠে তার আগেই অবশ্য তিনি বলে গেছেন, 'আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া'!

রবীন্দ্রনাথ মজুমদার ও কমলা দেবীর কন্যা সুপ্রীতির, সুরে দীক্ষা  হয়েছিল জন্মলগ্নেই। জ্যাঠামশাই নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন বিখ্যাত ক্ল্যারিওনেট বাদক ও বেতারের অন্যতম অনুষ্ঠান পরিচালক। সেই সুত্রে বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল সে-যুগের বিখ্যাত সুরসাধকদের। তারপর বাসন্তী বিদ্যাবীথিতে প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা, বিখ্যাত প্রশিক্ষক অনাদি দস্তিদারের আগ্রহেই। দিদি ভারতী আর বোন সুপ্রীতিকে সানন্দে বাসন্তী বিদ্যাবীথিতে ভর্তি করে নিয়েছিলেন মনোরঞ্জন সেন। ১৯৩৩ সালে এগারো বছর বয়সে বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুপ্রীতি। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেই বেতারে যাত্রা শুরু। গেয়েছিলেন, 'সন্ধ্যা হলো গো মা'। এরপর, ১৯৩৬ সালে সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হবার পর, সেই কোম্পানি থেকেই সুপ্রীতির প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। একপিঠে কাব্যসঙ্গীত, অন্যপিঠে কীর্তন।



সুপ্রীতি মজুমদার (ঘোষ)


 প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ওঁর অন্যতম গুরু শৈলেশ দত্তগুপ্ত। ১৯৪০ সালে পাইওনিয়ার কোম্পানির চুক্তিবদ্ধ শিল্পী হন সুপ্রীতি মজুমদার। পাইওনিয়ার কোম্পানিতেই, সঙ্গীতজীবনের প্রথম পর্বে, সুপ্রীতি রেকর্ড করেন গুরু শৈলেশ দত্তগুপ্ত, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী, নিহারবিন্দু সেনের মতো সেযুগের স্বনামধন্য সুরশ্রষ্ঠাদের গান। এঁদেরও ছিল জহুরির চোখ, সঠিক অধারকেই চয়ন করেছিলেন, তাঁদের অনন্য সুর শ্রোতার হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। লোকসুর, কীর্তনসুর, এমনকি পাশ্চাত্যসুরের অনন্য কিছু গান, এঁরা সার্থকভাবেই তুলে দিয়েছিলেন সুপ্রীতির কন্ঠে। এই কোম্পানির রেকর্ডেই প্রকাশিত হয় পরবর্তীকালের মান্না দে'র (তখন তিনি প্রবোধ দে) সুরারোপিত প্রথম গান, 'বালুকাবেলায় অলস খেলায় যায় বেলা' - শিল্পী, সুপ্রীতি মজুমদার। তখন সুপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, প্রথমে রাজি হন নি, নবাগত প্রবোধ দে'র সুরে গান করতে। পরে, যখন জানতে পারেন, তরুণ প্রবোধ হলেন কৃষ্ণচন্দ্র দের ভ্রাতুষ্পুত্র, তখন আর আপত্তি করতে পারেন নি। কৃষ্ণচন্দ্র দে'র সুরেও গান গেয়েছিলেন সুপ্রীতি।

১৯৪২-এর কোন এক সময়ের কথা। ততদিনে অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে সুপ্রীতি মজুমদার হয়েছেন সুপ্রীতি ঘোষ। একদিন রবীন চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে শিল্পী গেছেন শচীন দেববর্মনের কাছে। ডেকে পাঠিয়েছেন শচীনকর্তাই। ভয়ে ভয়ে গেছেন, অত বড় মানুষটাকে গান শোনাতে হবে যে! গান গাইলেন। পছন্দ হল শচীনকর্তার। সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল 'অভয়ের বিয়ে' ছবিতে গান করার সুযোগ। সেই প্রথম প্লেব্যাক। এদিকে রেকর্ডিং-এর দিন বিপত্তি! প্রচন্ড কাশি - গান গাওয়া অসম্ভব! কোনও ওষুধেই কাজ হচ্ছেনা। শচীনকর্তা দুটো ডাব কিনে আনালেন। 'ডাব খাইয়া লও। পেট গরম হইসে।' ব্যাস! কাশি উধাও! রেকর্ডিং-ও হল যথাসময়ে - 'মন বলে সে মেল মেল, নয়ন বলে না না না', 'এ কেমন দোলা, কে জানে', 'কুড়িয়ে মালা গাঁথবে কি না'!

সে যুগের বহু সুকন্ঠী, বিবাহের পর বাধ্য হয়েছিলেন রেকর্ড-বেতার-ছবির জগত থেকে অবসর নিতে। কিন্তু সুপ্রীতি ঘোষ বিবাহিতজীবনেও তাঁর উজ্জ্বল সঙ্গীতজীবন সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। স্বামীর অরবিন্দ ঘোষের সহায়তা তো ছিলই, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকেও অবাঞ্ছিত কোনও প্রশ্নের মুখে তাঁকে পড়তে হয়নি। একবার শুধু চিন্তায় পড়েছিলেন শ্বশুরমশাই মণিমোহন ঘোষ। সে এক রবিবার। সদ্যবিবাহিতা শিল্পী গেছেন রেকর্ডিং করতে। এদিকে শ্বশুরমশাই ভাবেন, ছুটির দিনেও বৌমা কোথায় যায়! এই ভেবে তিনি সোজা চলে গেলেন ষ্টুডিওতে। ষ্টুডিওয় সাড়া পড়লো, সুপ্রীতির শ্বশুরমশাই এসেছেন। সুপ্রীতি তক্ষুনি মাথায় কাপড় টেনে এক দৌড়ে ষ্টুডিওর বাইরে। ততক্ষণে মণিমোহনবাবু ফিরে গেছেন। আসলে তিনিও যে অনুরাগী ছিলেন বৌমার গানের! কখনও বা সস্নেহে বলতেন, 'বৌমা, 'ছোট্টবেলার স্বপন-ঘেরা' গানটা শোনাও' - মাঝে মাঝেই এ গান ওঁকে গেয়ে শোনাতে হত সুপ্রীতির।

১৯৪৬ সালে কলকাতার বুক রক্তাক্ত হল ভয়াবহ দাঙ্গায়। সে বছরই প্রথম, আলোর বেণু বাজিয়ে মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে দেবীবরণ করে নিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। সে-যুগে 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' অনুষ্ঠান আকাশবাণী থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হত। কিন্তু সে বছর দাঙ্গার কারণে, মধ্যরাত্রে শিল্পীদের আকাশবাণী আসার পথে বিপদের সম্ভাবনা থাকায়, মহালয়ার আগেই বেতারের ষ্টুডিওতে অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করে রাখা হয়। সে রেকর্ডিং মহালয়ার প্রত্যুষে যথাসময়ে বাজানো হয়। চল্লিশের দশকে, এই অনুষ্ঠানে, 'বাজলো তোমার আলোর বেণু' ছাড়াও সুপ্রীতি একককণ্ঠে গাইতেন 'বিমানে বিমানে আলোকের গানে' গানটি। কলকাতা বেতারের ঐতিহাসিক 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'-তে প্রথম অংশগ্রহনের পাশাপাশি, ১৯৪৬ সালে, সুপ্রীতি ঘোষ বিশ্ববিখ্যাত 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস' (এইচএমভি)- প্রথম রেকর্ড করেন। পাইওনিয়ার কোম্পানির চুক্তি শেষ হতে, বছর থেকে শিল্পী এইচএমভি' নিয়মিত শিল্পী হয়ে যান। ততদিনে সুপ্রীতি ঘোষ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে বিখ্যাত। এইচএমভি' যাত্রা শুরু হল, 'নিবেদিতা' (১৯৪৬) ছবির রেকর্ডে তাঁর কন্ঠে 'হে মাধবী দ্বিধা কেন' গানটির প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এর পর থেকে নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকল শিল্পীর কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। 'দুঃখে যাদের জীবন গড়া' (১৯৪৬), 'অলকানন্দা' (১৯৪৭), 'ঘরোয়া' (১৯৪৭), 'দৃষ্টিদান' (১৯৪৮), 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন' (১৯৫০), প্রভৃতি ছায়াছবিতেও, সুপ্রীতিকন্ঠে শোনা গেল কবিগুরুর গান। দ্বিজেন চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, কনক বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা সেন, প্রমুখ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গেও কন্ঠ মেলালেন সুপ্রীতি ঘোষ, বিভিন্ন রবীন্দ্রগানে।



পঙ্কজকুমার মল্লিক ও সুপ্রীতি ঘোষ 


এরপর, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাত্রে স্বাধীন হল ভারতবর্ষ। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রভাতে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হল সুপ্রীতি ঘোষের গান। সেই বিশেষ অনুষ্ঠানে সুপ্রীতি ছাড়াও অংশগ্রহণ করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, জগন্ময় মিত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সে বছরই আনন্দবাজার হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডস-এর যৌথ প্রযোজনায়, তিমিরবরণের পরিচালনায় সুপ্রীতি রেকর্ড করেন 'বন্দেমাতরম', সঙ্গে কন্ঠ মেলান বেচু দত্ত, জগন্ময় মিত্র রমা দেবী।

১৯৪৯ সালে সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় সুপ্রীতি অংশগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথের 'চন্ডালিকা' নাট্যে। গীতিনাট্য আকারে প্রকাশিত 'চন্ডালিকা'-, চন্ডালিকার মায়ের ভূমিকায় গান করেন সুপ্রীতি। আবার ১৯৫৬ সালে, দেবব্রত বিশ্বাস, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, পূরবী চট্টোপাধ্যায় (মুখোপাধ্যায়)-এর সঙ্গে 'চিত্রাঙ্গদা' নাট্যে অংশগ্রহণ করেন শিল্পী। চিত্রাঙ্গদা (সুরূপা)- ভূমিকায় তাঁর গান প্রশংসা অর্জন করে।

তিনবছর শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করার পর, ১৯৪৯ সালেই নিহারবিন্দু সেনের পরিচালনায় সুপ্রীতি আবার রেকর্ড করেন আধুনিক গান - 'দূরে থেকে কেন ডাক', 'তোমারে শোনাতে বাঁধিয়াছি বীণা' ততদিনে তাঁর কন্ঠ আরও পরিশীলিত, যেন আরও প্রাণ-ছুঁয়ে-যাওয়া। হয়ত বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবজগতে গভীরতরভাবে প্রবিষ্ট হবার সুযোগ পেয়েই, সুর-বাণীর মেলবন্ধনকে আরও নিবিড়ভাবে চিনতে শিখেছিলেন শিল্পী। গানদুটির মধ্য দিয়ে, সুপ্রীতির শিল্পীসত্তার একটি নবদিগন্ত যেন উন্মোচিত হল। দশকব্যাপী এক প্রস্তুতিপর্ব যেন সিদ্ধিলাভ করল। এই প্রস্তুতিপর্বের সাফল্যের অন্যতম নমুনা 'তথাপি' (১৯৫০) ছবিতে, রবীন রায় শৈলেন রায়ের পরিচালনায়, সুপ্রীতিকন্ঠে কবি অতুলপ্রসাদের 'ওগো সাথী মম সাথী' গানের হৃদয়স্পর্শী পরিবেশন। এরপরেও 'তোমার ভাবনা ভাবলে আমার', 'কতকাল রবে নিজ', 'মন রে আমার তুই', প্রভৃতি গানে অতুলপ্রসাদিতে অনন্য দক্ষতার চিহ্ন রেখেছিলেন শিল্পী। ইতিমধ্যে, ১৯৫২ সালে 'দত্তা' ছায়াছবিতে সুপ্রীতি ঘোষের কন্ঠে শোনা গেলো রবীন্দ্রগান 'দীপ নিভে গেছে মম' গান বহু আগে রেকর্ড করেছিলেন রবীন্দ্রস্নেহধন্য কনক বিশ্বাস। সুপ্রীতির গানটি শুনে মনে হয়, কনক দাসের সুযোগ্য উত্তরসূরি ততদিনে হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 'দত্তা' ছবিতে শিল্পীর কণ্ঠে গানটি শুনলে, রবীন্দ্রগানের অন্যতম সার্থক শিল্পী হিসাবে সুপ্রীতি ঘোষকে পরিচিত করতে কোনও দ্বিধা হয়না।

নিখুঁত উচ্চারণ সুপ্রীতি ঘোষের গানের বৈশিষ্ট। গানের প্রতিটি শব্দকেই তিনি সমান গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। এক রকম 'বাণীপ্রাধান্য' থাকা সত্তেও, ওঁর গানে সুরের রেশ কিন্তু কখনও কাটেনা। সুর যেন বাণীকেই আরও মধুর করে তোলে। ব্যঞ্জনা সৃষ্টির মসৃণ পথ তৈরী করে দেয়। তাই সুপ্রীতির গানে কখনই কোনও 'জার্ক' থাকেনা, থাকে এক অতুলনীয় 'এলিগেন্স' ওঁর প্রতিটি গানই, এই লালিত্যের চিহ্নটি বহন করে। শিল্পীর গানে, আবেগপ্রকাশের প্রাবল্য নেই। আবেগকে সুরস্রোতে বিলীন করে, এক অনন্য বৈরাগ্যের রাগিনী যেন বাজতে থাকে সুপ্রীতি ঘোষের গানে। তাই ১৯৫২- পুজোর রেকর্ডে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে যখন সুপ্রীতি গেয়ে ওঠেন, 'যেথায় গেলে হারায় সবাই ফেরার ঠিকানা গো' - সে উচ্চারণে থাকেনা নিরাশার লেশমাত্র। বেদনার সুরটি থাকে। তার পাশাপাশি যেন এক অদ্ভুত তৃপ্তিবোধও প্রকাশ পায়, যার জন্ম, চিত্তের প্রশান্তির থেকে। সে প্রশান্তির সাথে কোথায় যেন এসে মেশে ঔদাস্য। অথচ এই বেদনা, তৃপ্তি, প্রশান্তি, ঔদাস্য, কোনটিরই বিছিন্ন প্রকাশ নেই - সুপ্রীতির গায়নের সঙ্গে এর নির্যাসটি শুধু মিলেমিশে আছে অধিধ্বনির মত। আবার ১৯৫৫- পুজোর রেকর্ডে নচিকেতা ঘোষের সুরে 'কৃষ্ণচুড়ার স্বপ্নঝরা' গানে 'তুমি শুধু নেই'-এর হাহাকার কি অক্লেশে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পী! অথচ এই বিছিন্ন শব্দসমষ্টিমাত্র তাঁর লক্ষ্য নয়। অখন্ড গানটিকেই তাই 'তুমি শুধু নেই'-এর হাহাকারে ভরিয়ে তোলেন সুপ্রীতি। সে আর্তির প্রকাশ অন্তর্মুখী - অন্তর্মুখীনতাই সে আর্তির প্রকৃত রূপকে ফুটিয়ে তোলে, কাব্যিক দ্যোতনায়।

সুপ্রীতির গানের উপস্থাপনা কাব্যময়। এই কাব্যময়তার সঙ্গে মেশে সুরের অখন্ড রেশটি। দিলীপ সরকার কৃত পাশ্চাত্যসুরে, ১৯৫৬- পুজোর রেকর্ডের 'পদ্মকলি সকাল খোঁজে' গানটি কি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে গান শিল্পী! গায়নের স্বভাবসিদ্ধ সৌষাম্য অক্ষুন্ন রেখেই, কী সাবলীলভাবে প্রতিটি স্তবকের শেষের ক্রোমাটিক নোটের অংশগুলি পরিবেশন করেন! স্তবকশেষের ওই অপূর্ব ক্রমাটিক নোট লাগানোই গানে 'নয়ন দিশাহারা'- সাঙ্গীতিক রূপক হয়ে ওঠে যেন! দ্রুতলয়ের গান, তুলনামূলকভাবে কম গেয়েছেন সুপ্রীতি ঘোষ। ১৯৫৭- পুজোর রেকর্ডে, 'এই ফুলের দেশে'- মধ্য দিয়ে, দ্রুতলয়ের গানেও ওঁর সাবলীলতা প্রমান করলেন শিল্পী। লয় গানে প্রকট হলেও, কখনই প্রধান হয়ে উঠে, গানের মসৃণ গতিকে নষ্ট করেনা। তাই গানটির কাব্যগুণ ক্ষুন্ন হয়না। লয়ের প্রাকট্যে গানের বাণীর গুরুত্বটি কিছুমাত্র লঘু হয়ে যায়না। গানে ভাবপ্রকাশের সহায়ক হিসাবেই কার্যকর হয় লয়। শিল্পীও দক্ষতার সঙ্গে, দ্রুতলয়কে সঙ্গী মাত্র করেন - নিয়ন্ত্রক করেন না।

সুদূর অতীতকালের কৃষ্ণচন্দ্র দে বা সুরসাগর হিমাংশু দত্তের সুরে যে সুপ্রীতি ঘোষ গেয়েছিলেন অনায়াসে, ১৯৫৯-এর নভেম্বর মাসের রেকর্ডে নবপ্রজন্মের অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে 'এত সুন্দর জীবন' গাইলেন একই সাবলীলতায়। এই ছিল শিল্পীর শেষ প্রকাশিত আধুনিক গানের রেকর্ড। ততদিনে তিনি গানের জগতে প্রায় মাতৃসমা। অনল চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ নবাগত সুরকারদের ওঁর গানে সুরারোপ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। শেষ রেকর্ডে অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরেই আরও একটা গান গেয়েছিলেন শিল্পী, 'আমার গান ওই সাত রঙে রঙে সাজাল আকাশের আঙিনা' - উনি কি বুঝেছিলেন, আঙিনা সাজানোর পালা ওঁর প্রায় শেষ? না, তখনও শেষ হয়নি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সুপ্রীতি ঘোষকে আমন্ত্রণ জানায় এইচএমভি। দীর্ঘ সাত বছর পর, আবার প্রকাশিত হয় শিল্পীর কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেই রেকর্ড থেকে ওঁর কন্ঠে 'গরব মম হরেছ প্রভু' গানটি শুনে, পরিনততর রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুপ্রীতি ঘোষকে বারবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। সময়ের সাথে সাথে শিল্পীর কন্ঠস্বরে পরিবর্তন আসে, স্বরক্ষেপনেও ঘটে পরিবর্তন। কিন্তু বোধ পরিনত থেকে পরিনততর হতেই থাকে। সেই পরিনততর বোধদীপ্ত সুপ্রীতিকে অবশ্য রেকর্ডের জগতে সরাসরিভাবে আর পাওয়া যায়নি। দুর্ভাগ্যের ভাগী তাঁর একনিষ্ঠ শ্রোতারাই।



সঙ্গীত পরিবেশনরত সুপ্রীতি ঘোষ  


এর এক দশক পর, একটিবারের জন্য রেকর্ডের জগতে ফিরে এসেছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। ১৯৭২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ডস (বা ইনরেকো) কোম্পানি থেকে ওঁর একটি এক্সটেন্ডেড-প্লে রেকর্ড প্রকাশিত হয়। সে রেকর্ডে শিল্পীর কন্ঠে দুটি অতুলপ্রসাদী গানের অনন্য উপস্থাপন শুনি - 'মোর আঙিনায় আজি পাখি' 'মনপথে এল বনহরিণী' সে বছরই পুজোয়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সঙ্গীতবীথি  'শ্রীশ্রী দেবী চণ্ডিকা'- একটি গান পরিবেশনা করেন সুপ্রীতি ঘোষ - 'মোর সকল সত্তা বিলিয়ে দিলাম, লুটিয়ে দিলাম ওই চরণে' সুদূর ১৯৪৬ সালে যে শিল্পী আলোর বেণু বাজিয়ে বিশ্বমাতৃকাকে বরণ করে নিয়েছিলেন, এই শেষলগ্নে তাঁর চরণেই নিজের সবটুকু উজাড় করে দিলেন। এরপর হিন্দুস্থান রেকর্ডস কোম্পানি থেকেও সুপ্রীতি ঘোষের আর কোনও রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি।

শ্রোতাদের বঞ্চিত করেন নি সুপ্রীতি। রেকর্ড করা বন্ধ হলেও আকাশবাণী, দূরদর্শন আর নানা অনুষ্ঠানে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করে গেছেন এর পরেও, বহুকাল। সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছেন জীবনের নানা গল্প। শ্রোতারাও ভোলেন নি ওঁর গান। একবার বিদেশের অনুষ্ঠানে অনেকের অনুরোধে ওঁর বহু পুরানো গান ধরেন সুপ্রীতি, 'আকাশে লক্ষ তারার দেওয়ালী' - কিছুটা গেয়েই ভুলে যান গানের কথা। উনি ভুললেও গানের কথা ভোলেন নি শ্রোতারা, কথাগুলো বলে বলে দিলেন শিল্পীকে। শিল্পীও শ্রোতাদের সহযোগিতায় গেয়ে উঠলেন বহুকালের আগের সেই গান। তবু, প্রথম লগ্নের ঔজ্জল্যের বিপরীতে সুপ্রীতি ঘোষের রেকর্ডজীবনের শেষ লগ্নের নিষ্প্রভতা যেন এক অন্তহীন শূণ্যতার বোধে মনকে ভারাক্রান্ত করে। কিন্তু 'ক্লান্তি যদি নামে, শ্রান্ত চরণ থেমে যায়, ওগো সাথী আশার বাতি, জ্বেলে দিও হিয়ায়' - সে সুর থেকে যায়!


তাই কৃষ্ণচূড়ার স্বপ্নঝরা চৈত্রমাসের সন্ধ্যাবেলায় তিনি আজও আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালী জ্বালিয়ে, পাহাড়ি-ঝরনাধারার ঝুমঝুমির সুরে গেয়ে চলেন অবিরাম! ফুলের দেশের ভ্রমরের সে কানাকানি যে শেষ হওয়ার নয়!