রবীন্দ্রনাথের
আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে শুরু হয়েছিল সঙ্গীতজীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়। পাইওনিয়ার কোম্পানি
থেকে রেকর্ড করেছিলেন, 'কে বলে 'যাও যাও' আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া' - স্যাম্পল রেকর্ড
পৌঁছালো শান্তিনিকেতনে, কবির হাতে। সে গান শুনে, তিনি অনুমোদন তো করলেনই, সঙ্গে পাঠালেন
আশীর্বাণী। কুমারী সুপ্রীতি মজুমদারের একক কন্ঠে প্রথম প্রকাশিত হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের
রেকর্ড। তখন ১৯৪১। সে বছরই রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ হল, কিশোরী শিল্পীর কন্ঠে তার আগেই
অবশ্য তিনি বলে গেছেন, 'আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া'!
রবীন্দ্রনাথ
মজুমদার ও কমলা দেবীর কন্যা সুপ্রীতির, সুরে দীক্ষা হয়েছিল জন্মলগ্নেই। জ্যাঠামশাই নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার
ছিলেন বিখ্যাত ক্ল্যারিওনেট বাদক ও বেতারের অন্যতম অনুষ্ঠান পরিচালক। সেই সুত্রে বাড়িতে
যাওয়া-আসা ছিল সে-যুগের বিখ্যাত সুরসাধকদের। তারপর বাসন্তী বিদ্যাবীথিতে প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা,
বিখ্যাত প্রশিক্ষক অনাদি দস্তিদারের আগ্রহেই। দিদি ভারতী আর বোন সুপ্রীতিকে সানন্দে
বাসন্তী বিদ্যাবীথিতে ভর্তি করে নিয়েছিলেন মনোরঞ্জন সেন। ১৯৩৩ সালে এগারো বছর বয়সে
বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুপ্রীতি। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেই বেতারে যাত্রা শুরু।
গেয়েছিলেন, 'সন্ধ্যা হলো গো মা'। এরপর, ১৯৩৬ সালে সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত
হবার পর, সেই কোম্পানি থেকেই সুপ্রীতির প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। একপিঠে কাব্যসঙ্গীত,
অন্যপিঠে কীর্তন।
সুপ্রীতি মজুমদার (ঘোষ)
প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ওঁর অন্যতম গুরু শৈলেশ
দত্তগুপ্ত। ১৯৪০ সালে পাইওনিয়ার কোম্পানির চুক্তিবদ্ধ শিল্পী হন সুপ্রীতি মজুমদার।
পাইওনিয়ার কোম্পানিতেই, সঙ্গীতজীবনের প্রথম পর্বে, সুপ্রীতি রেকর্ড করেন গুরু শৈলেশ
দত্তগুপ্ত, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী, নিহারবিন্দু সেনের মতো সেযুগের
স্বনামধন্য সুরশ্রষ্ঠাদের গান। এঁদেরও ছিল জহুরির চোখ, সঠিক অধারকেই চয়ন করেছিলেন,
তাঁদের অনন্য সুর শ্রোতার হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। লোকসুর, কীর্তনসুর, এমনকি পাশ্চাত্যসুরের
অনন্য কিছু গান, এঁরা সার্থকভাবেই তুলে দিয়েছিলেন সুপ্রীতির কন্ঠে। এই কোম্পানির রেকর্ডেই
প্রকাশিত হয় পরবর্তীকালের মান্না দে'র (তখন তিনি প্রবোধ দে) সুরারোপিত প্রথম গান,
'বালুকাবেলায় অলস খেলায় যায় বেলা' - শিল্পী, সুপ্রীতি মজুমদার। তখন সুপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত
শিল্পী, প্রথমে রাজি হন নি, নবাগত প্রবোধ দে'র সুরে গান করতে। পরে, যখন জানতে পারেন,
তরুণ প্রবোধ হলেন কৃষ্ণচন্দ্র দের ভ্রাতুষ্পুত্র, তখন আর আপত্তি করতে পারেন নি। কৃষ্ণচন্দ্র
দে'র সুরেও গান গেয়েছিলেন সুপ্রীতি।
১৯৪২-এর কোন
এক সময়ের কথা। ততদিনে অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে সুপ্রীতি মজুমদার হয়েছেন সুপ্রীতি
ঘোষ। একদিন রবীন চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে শিল্পী গেছেন শচীন দেববর্মনের কাছে। ডেকে পাঠিয়েছেন
শচীনকর্তাই। ভয়ে ভয়ে গেছেন, অত বড় মানুষটাকে গান শোনাতে হবে যে! গান গাইলেন। পছন্দ
হল শচীনকর্তার। সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল 'অভয়ের বিয়ে' ছবিতে গান করার সুযোগ। সেই প্রথম
প্লেব্যাক। এদিকে রেকর্ডিং-এর দিন বিপত্তি! প্রচন্ড কাশি - গান গাওয়া অসম্ভব! কোনও
ওষুধেই কাজ হচ্ছেনা। শচীনকর্তা দুটো ডাব কিনে আনালেন। 'ডাব খাইয়া লও। পেট গরম হইসে।'
ব্যাস! কাশি উধাও! রেকর্ডিং-ও হল যথাসময়ে - 'মন বলে সে মেল মেল, নয়ন বলে না না না',
'এ কেমন দোলা, কে জানে', 'কুড়িয়ে মালা গাঁথবে কি না'!
সে যুগের
বহু সুকন্ঠী, বিবাহের পর বাধ্য হয়েছিলেন রেকর্ড-বেতার-ছবির জগত থেকে অবসর নিতে। কিন্তু
সুপ্রীতি ঘোষ বিবাহিতজীবনেও তাঁর উজ্জ্বল সঙ্গীতজীবন সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ
পেয়েছিলেন। স্বামীর অরবিন্দ ঘোষের সহায়তা তো ছিলই, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকেও
অবাঞ্ছিত কোনও প্রশ্নের মুখে তাঁকে পড়তে হয়নি। একবার শুধু চিন্তায় পড়েছিলেন শ্বশুরমশাই
মণিমোহন ঘোষ। সে এক রবিবার। সদ্যবিবাহিতা শিল্পী গেছেন রেকর্ডিং করতে। এদিকে শ্বশুরমশাই
ভাবেন, ছুটির দিনেও বৌমা কোথায় যায়! এই ভেবে তিনি সোজা চলে গেলেন ষ্টুডিওতে। ষ্টুডিওয়
সাড়া পড়লো, সুপ্রীতির শ্বশুরমশাই এসেছেন। সুপ্রীতি তক্ষুনি মাথায় কাপড় টেনে এক দৌড়ে
ষ্টুডিওর বাইরে। ততক্ষণে মণিমোহনবাবু ফিরে গেছেন। আসলে তিনিও যে অনুরাগী ছিলেন বৌমার
গানের! কখনও বা সস্নেহে বলতেন, 'বৌমা, 'ছোট্টবেলার স্বপন-ঘেরা' গানটা শোনাও' - মাঝে
মাঝেই এ গান ওঁকে গেয়ে শোনাতে হত সুপ্রীতির।
১৯৪৬
সালে কলকাতার বুক রক্তাক্ত হল ভয়াবহ দাঙ্গায়।
সে বছরই প্রথম, আলোর বেণু বাজিয়ে মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে দেবীবরণ করে নিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। সে-যুগে 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'
অনুষ্ঠান আকাশবাণী থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হত। কিন্তু সে বছর দাঙ্গার
কারণে, মধ্যরাত্রে শিল্পীদের আকাশবাণী আসার পথে বিপদের সম্ভাবনা থাকায়, মহালয়ার আগেই বেতারের ষ্টুডিওতে অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করে রাখা হয়। সে রেকর্ডিং মহালয়ার
প্রত্যুষে যথাসময়ে বাজানো হয়। চল্লিশের দশকে, এই অনুষ্ঠানে, 'বাজলো
তোমার আলোর বেণু' ছাড়াও সুপ্রীতি একককণ্ঠে গাইতেন 'বিমানে বিমানে আলোকের গানে' গানটি। কলকাতা বেতারের ঐতিহাসিক 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী'-তে প্রথম অংশগ্রহনের
পাশাপাশি, ১৯৪৬ সালে, সুপ্রীতি ঘোষ বিশ্ববিখ্যাত 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস' (এইচএমভি)-এ প্রথম রেকর্ড
করেন। পাইওনিয়ার কোম্পানির চুক্তি শেষ হতে, এ বছর থেকে
শিল্পী এইচএমভি'র নিয়মিত শিল্পী
হয়ে যান। ততদিনে সুপ্রীতি ঘোষ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে বিখ্যাত। এইচএমভি'র যাত্রা শুরু
হল, 'নিবেদিতা' (১৯৪৬) ছবির রেকর্ডে তাঁর কন্ঠে 'হে মাধবী দ্বিধা
কেন' গানটির প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এর পর থেকে
নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকল শিল্পীর কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। 'দুঃখে যাদের জীবন গড়া' (১৯৪৬), 'অলকানন্দা' (১৯৪৭), 'ঘরোয়া' (১৯৪৭), 'দৃষ্টিদান' (১৯৪৮), 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন' (১৯৫০), প্রভৃতি ছায়াছবিতেও, সুপ্রীতিকন্ঠে শোনা গেল কবিগুরুর গান। দ্বিজেন চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, কনক বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা সেন, প্রমুখ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গেও কন্ঠ মেলালেন সুপ্রীতি ঘোষ, বিভিন্ন রবীন্দ্রগানে।
পঙ্কজকুমার মল্লিক ও সুপ্রীতি ঘোষ
এরপর,
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাত্রে স্বাধীন হল ভারতবর্ষ। স্বাধীন
ভারতের প্রথম প্রভাতে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হল সুপ্রীতি ঘোষের
গান। সেই বিশেষ অনুষ্ঠানে সুপ্রীতি ছাড়াও অংশগ্রহণ করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, জগন্ময় মিত্র ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সে বছরই আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডস-এর যৌথ প্রযোজনায়,
তিমিরবরণের পরিচালনায় সুপ্রীতি রেকর্ড করেন 'বন্দেমাতরম', সঙ্গে কন্ঠ মেলান বেচু দত্ত, জগন্ময় মিত্র ও রমা দেবী।
১৯৪৯
সালে সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় সুপ্রীতি অংশগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথের 'চন্ডালিকা' নাট্যে। গীতিনাট্য আকারে প্রকাশিত 'চন্ডালিকা'-য়, চন্ডালিকার মায়ের
ভূমিকায় গান করেন সুপ্রীতি। আবার ১৯৫৬ সালে, দেবব্রত বিশ্বাস, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, পূরবী চট্টোপাধ্যায় (মুখোপাধ্যায়)-এর সঙ্গে 'চিত্রাঙ্গদা'
নাট্যে অংশগ্রহণ করেন শিল্পী। চিত্রাঙ্গদা (সুরূপা)-র ভূমিকায় তাঁর
গান প্রশংসা অর্জন করে।
তিনবছর
শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করার পর, ১৯৪৯ সালেই নিহারবিন্দু সেনের পরিচালনায় সুপ্রীতি আবার রেকর্ড করেন আধুনিক গান - 'দূরে থেকে কেন ডাক', 'তোমারে শোনাতে বাঁধিয়াছি বীণা'। ততদিনে তাঁর
কন্ঠ আরও পরিশীলিত, যেন আরও প্রাণ-ছুঁয়ে-যাওয়া। হয়ত বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবজগতে গভীরতরভাবে
প্রবিষ্ট হবার সুযোগ পেয়েই, সুর-বাণীর মেলবন্ধনকে আরও নিবিড়ভাবে চিনতে শিখেছিলেন শিল্পী। এ গানদুটির মধ্য
দিয়ে, সুপ্রীতির শিল্পীসত্তার একটি নবদিগন্ত যেন উন্মোচিত হল। দশকব্যাপী এক প্রস্তুতিপর্ব যেন
সিদ্ধিলাভ করল। এই প্রস্তুতিপর্বের সাফল্যের অন্যতম
নমুনা 'তথাপি' (১৯৫০) ছবিতে, রবীন রায় ও শৈলেন রায়ের
পরিচালনায়, সুপ্রীতিকন্ঠে কবি অতুলপ্রসাদের 'ওগো সাথী মম সাথী' গানের
হৃদয়স্পর্শী পরিবেশন। এরপরেও 'তোমার ভাবনা ভাবলে আমার', 'কতকাল রবে নিজ', 'মন রে আমার
তুই', প্রভৃতি গানে অতুলপ্রসাদিতে অনন্য দক্ষতার চিহ্ন রেখেছিলেন শিল্পী। ইতিমধ্যে, ১৯৫২ সালে 'দত্তা' ছায়াছবিতে সুপ্রীতি ঘোষের কন্ঠে শোনা গেলো রবীন্দ্রগান 'দীপ নিভে গেছে মম'। এ
গান বহু আগে রেকর্ড করেছিলেন রবীন্দ্রস্নেহধন্য কনক বিশ্বাস। সুপ্রীতির গানটি শুনে মনে হয়, কনক দাসের সুযোগ্য উত্তরসূরি ততদিনে হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 'দত্তা' ছবিতে শিল্পীর কণ্ঠে গানটি শুনলে, রবীন্দ্রগানের অন্যতম সার্থক শিল্পী হিসাবে সুপ্রীতি ঘোষকে পরিচিত করতে কোনও দ্বিধা হয়না।
নিখুঁত
উচ্চারণ সুপ্রীতি ঘোষের গানের বৈশিষ্ট। গানের প্রতিটি শব্দকেই তিনি সমান গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। এক রকম 'বাণীপ্রাধান্য'
থাকা সত্তেও, ওঁর গানে সুরের রেশ কিন্তু কখনও কাটেনা। সুর যেন বাণীকেই আরও মধুর করে তোলে। ব্যঞ্জনা সৃষ্টির মসৃণ পথ তৈরী করে
দেয়। তাই সুপ্রীতির গানে কখনই কোনও 'জার্ক' থাকেনা, থাকে এক অতুলনীয় 'এলিগেন্স'। ওঁর প্রতিটি
গানই, এই লালিত্যের চিহ্নটি
বহন করে। শিল্পীর গানে, আবেগপ্রকাশের প্রাবল্য নেই। আবেগকে সুরস্রোতে বিলীন করে, এক অনন্য বৈরাগ্যের
রাগিনী যেন বাজতে থাকে সুপ্রীতি ঘোষের গানে। তাই ১৯৫২-র পুজোর রেকর্ডে
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে যখন সুপ্রীতি গেয়ে ওঠেন, 'যেথায় গেলে হারায় সবাই ফেরার ঠিকানা গো' - সে উচ্চারণে থাকেনা
নিরাশার লেশমাত্র। বেদনার সুরটি থাকে। তার পাশাপাশি যেন এক অদ্ভুত তৃপ্তিবোধও
প্রকাশ পায়, যার জন্ম, চিত্তের প্রশান্তির থেকে। সে প্রশান্তির সাথে
কোথায় যেন এসে মেশে ঔদাস্য। অথচ এই বেদনা, তৃপ্তি,
প্রশান্তি, ঔদাস্য, কোনটিরই বিছিন্ন প্রকাশ নেই - সুপ্রীতির গায়নের সঙ্গে এর নির্যাসটি শুধু
মিলেমিশে আছে অধিধ্বনির মত। আবার ১৯৫৫-র পুজোর রেকর্ডে
নচিকেতা ঘোষের সুরে 'কৃষ্ণচুড়ার স্বপ্নঝরা' গানে 'তুমি শুধু নেই'-এর হাহাকার কি
অক্লেশে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পী! অথচ এই বিছিন্ন শব্দসমষ্টিমাত্র
তাঁর লক্ষ্য নয়। অখন্ড গানটিকেই তাই 'তুমি শুধু নেই'-এর হাহাকারে ভরিয়ে
তোলেন সুপ্রীতি। সে আর্তির প্রকাশ
অন্তর্মুখী - অন্তর্মুখীনতাই সে আর্তির প্রকৃত
রূপকে ফুটিয়ে তোলে, কাব্যিক দ্যোতনায়।
সুপ্রীতির
গানের উপস্থাপনা কাব্যময়। এই কাব্যময়তার সঙ্গে
মেশে সুরের অখন্ড রেশটি। দিলীপ সরকার কৃত পাশ্চাত্যসুরে, ১৯৫৬-র পুজোর রেকর্ডের
'পদ্মকলি সকাল খোঁজে' গানটি কি অসাধারণ দক্ষতার
সঙ্গে গান শিল্পী! গায়নের স্বভাবসিদ্ধ সৌষাম্য অক্ষুন্ন রেখেই, কী সাবলীলভাবে প্রতিটি
স্তবকের শেষের ক্রোমাটিক নোটের অংশগুলি পরিবেশন করেন! স্তবকশেষের ওই অপূর্ব ক্রমাটিক
নোট লাগানোই এ গানে 'নয়ন
দিশাহারা'-র সাঙ্গীতিক রূপক
হয়ে ওঠে যেন! দ্রুতলয়ের গান, তুলনামূলকভাবে কম গেয়েছেন সুপ্রীতি
ঘোষ। ১৯৫৭-র পুজোর রেকর্ডে,
'এই ফুলের দেশে'-র মধ্য দিয়ে,
দ্রুতলয়ের গানেও ওঁর সাবলীলতা প্রমান করলেন শিল্পী। লয় এ গানে
প্রকট হলেও, কখনই প্রধান হয়ে উঠে, গানের মসৃণ গতিকে নষ্ট করেনা। তাই গানটির কাব্যগুণ ক্ষুন্ন হয়না। লয়ের প্রাকট্যে গানের বাণীর গুরুত্বটি কিছুমাত্র লঘু হয়ে যায়না। এ গানে ভাবপ্রকাশের
সহায়ক হিসাবেই কার্যকর হয় লয়। শিল্পীও
দক্ষতার সঙ্গে, দ্রুতলয়কে সঙ্গী মাত্র করেন - নিয়ন্ত্রক করেন না।
সুদূর
অতীতকালের কৃষ্ণচন্দ্র দে বা সুরসাগর
হিমাংশু দত্তের সুরে যে সুপ্রীতি ঘোষ
গেয়েছিলেন অনায়াসে, ১৯৫৯-এর নভেম্বর মাসের
রেকর্ডে নবপ্রজন্মের অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে 'এত সুন্দর এ
জীবন' গাইলেন একই সাবলীলতায়। এই ছিল শিল্পীর
শেষ প্রকাশিত আধুনিক গানের রেকর্ড। ততদিনে তিনি গানের জগতে প্রায় মাতৃসমা। অনল চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ নবাগত সুরকারদের ওঁর গানে সুরারোপ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। শেষ রেকর্ডে অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরেই আরও একটা গান গেয়েছিলেন শিল্পী, 'আমার গান ওই সাত রঙে
রঙে সাজাল আকাশের আঙিনা' - উনি কি বুঝেছিলেন, আঙিনা
সাজানোর পালা ওঁর প্রায় শেষ? না, তখনও শেষ হয়নি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সুপ্রীতি ঘোষকে আমন্ত্রণ জানায় এইচএমভি। দীর্ঘ সাত বছর পর, আবার প্রকাশিত হয় শিল্পীর কন্ঠে
রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেই রেকর্ড থেকে ওঁর কন্ঠে 'গরব মম হরেছ প্রভু'
গানটি শুনে, পরিনততর রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুপ্রীতি ঘোষকে বারবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। সময়ের সাথে সাথে শিল্পীর কন্ঠস্বরে পরিবর্তন আসে, স্বরক্ষেপনেও ঘটে পরিবর্তন। কিন্তু বোধ পরিনত থেকে পরিনততর হতেই থাকে। সেই পরিনততর বোধদীপ্ত সুপ্রীতিকে অবশ্য রেকর্ডের জগতে সরাসরিভাবে আর পাওয়া যায়নি।
এ দুর্ভাগ্যের ভাগী তাঁর একনিষ্ঠ শ্রোতারাই।
সঙ্গীত পরিবেশনরত সুপ্রীতি ঘোষ
এর
এক দশক পর, একটিবারের জন্য রেকর্ডের জগতে ফিরে এসেছিলেন সুপ্রীতি ঘোষ। ১৯৭২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ডস (বা ইনরেকো) কোম্পানি
থেকে ওঁর একটি এক্সটেন্ডেড-প্লে রেকর্ড প্রকাশিত হয়। সে রেকর্ডে শিল্পীর
কন্ঠে দুটি অতুলপ্রসাদী গানের অনন্য উপস্থাপন শুনি - 'মোর আঙিনায় আজি পাখি' ও 'মনপথে এল
বনহরিণী'। সে বছরই
পুজোয়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সঙ্গীতবীথি 'শ্রীশ্রী
দেবী চণ্ডিকা'-য় একটি গান
পরিবেশনা করেন সুপ্রীতি ঘোষ - 'মোর সকল সত্তা বিলিয়ে দিলাম, লুটিয়ে দিলাম ওই চরণে'।
সুদূর ১৯৪৬ সালে যে শিল্পী আলোর
বেণু বাজিয়ে বিশ্বমাতৃকাকে বরণ করে নিয়েছিলেন, এই শেষলগ্নে তাঁর
চরণেই নিজের সবটুকু উজাড় করে দিলেন। এরপর হিন্দুস্থান রেকর্ডস কোম্পানি থেকেও সুপ্রীতি ঘোষের আর কোনও রেকর্ড
প্রকাশিত হয়নি।
শ্রোতাদের
বঞ্চিত করেন নি সুপ্রীতি। রেকর্ড
করা বন্ধ হলেও আকাশবাণী, দূরদর্শন আর নানা অনুষ্ঠানে
নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করে গেছেন এর পরেও, বহুকাল।
সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছেন জীবনের নানা গল্প। শ্রোতারাও ভোলেন নি ওঁর গান।
একবার বিদেশের অনুষ্ঠানে অনেকের অনুরোধে ওঁর বহু পুরানো গান ধরেন সুপ্রীতি, 'আকাশে লক্ষ তারার দেওয়ালী' - কিছুটা গেয়েই ভুলে যান গানের কথা। উনি ভুললেও গানের কথা ভোলেন নি শ্রোতারা, কথাগুলো
বলে বলে দিলেন শিল্পীকে। শিল্পীও শ্রোতাদের সহযোগিতায় গেয়ে উঠলেন বহুকালের আগের সেই গান। তবু, প্রথম লগ্নের ঔজ্জল্যের বিপরীতে সুপ্রীতি ঘোষের রেকর্ডজীবনের শেষ লগ্নের নিষ্প্রভতা যেন এক অন্তহীন শূণ্যতার
বোধে মনকে ভারাক্রান্ত করে। কিন্তু 'ক্লান্তি যদি নামে, শ্রান্ত চরণ থেমে যায়, ওগো সাথী আশার বাতি, জ্বেলে দিও এ হিয়ায়' - সে
সুর থেকে যায়!
তাই
কৃষ্ণচূড়ার স্বপ্নঝরা চৈত্রমাসের সন্ধ্যাবেলায় তিনি আজও আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালী জ্বালিয়ে, পাহাড়ি-ঝরনাধারার ঝুমঝুমির সুরে গেয়ে চলেন অবিরাম! ফুলের দেশের ভ্রমরের সে কানাকানি যে
শেষ হওয়ার নয়!



No comments:
Post a Comment