Monday, 27 March 2017

নীলিমার সুরে

[ বিশেষ কৃতজ্ঞতা : শ্রী গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ]


‘প্রয়াত হয়েছেন গায়িকা নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়’ – জানাতেই প্রশ্ন উঠল...

ইনি কে? গায়িকা? জানতাম না তো!

অবাক হলাম?

না, হইনি।

নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় 

প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয়। এই শিল্পীর গানের প্রচার কতটা ? বড়জোর বড়সড় সিডি সেটে একটা গান ওঁর নামে। আরও তো কত অপূর্ব গান গেয়েছেন! পরের দোষ দেখব কেনআমি নিজেই লজ্জিত। এতকাল জীবিত ছিলেন নীলিমা দেবী - ওঁর কথা লিখেছি বা ওঁর গান নিয়ে আলোচনা করেছি বলে প্রায় মনেই পড়েনা। প্রয়াণের পর তাকালাম ফিরে বর্তমানের কদর করতে যেন নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করা, তার অতীত হওয়ার। দেখতে দেখতে কত বর্তমান অতীত হল!

-   গায়িকা?

-   জানতেন না? ওঃ! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী ইনি

-   ও! তাই বল!

কী বলি!

১৯২৯ সালের ২৮এ মার্চ জন্ম নীলিমা মুখোপাধ্যায়ের। হ্যাঁ, তখন মুখোপাধ্যায়। পরেশ মুখোপাধ্যায়, শিশুবালা দেবীর কন্যা। থাকতেন রসা রোডে। তিরিশের দশকের কথা, ছোট্ট নীলিমার সুকন্ঠী দিদিকে গান শিখাতে আসতেন মাস্টারমশাই। সেদিন আর খেলতে যাওয়া হতনা নীলিমার। বসে বসে আপনমনে গান শুনতে থাকতেন। শুনতে শুনতে কখন যে সেই সুরই রক্তে বইতে থাকত, সে কি আর বুঝতেন! একবার কোন এক রাগে কঠিন তান শিখাচ্ছেন মাস্টারমশাই – দিদি কিছুতেই সেই তান পারেন না। ছোট্ট নীলিমা বলেই ফেললেন – আমি করি? অতটুকু মেয়ের গলায় সেই কঠিন তান শুনে মাস্টারমশাই অবাক। সেই শুরু।

রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে

রসা রোডের বাড়ির কাছেই সপরিবারে থাকতেন অমলাশঙ্করের বাবা, অক্ষয় নন্দী। পারিবারিক যোগাযোগের সূত্রে অক্ষয়বাবুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বছর বারো-তেরোর নীলিমা গেছেন ওঁদের বাড়ি। অতিথিদের মধ্যে এসেছেন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান চলছে। নীলিমাকে দেখিয়ে অক্ষয় নন্দী বললেন, ‘মধু (সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ডাকনাম), এই মেয়েটির গান শোনো।’ গান শেষে তিনিই বললেন, ‘ওকে গান শেখাবে? ওর কিন্তু গান হবে।’ রাজি হয়ে গেলেন সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়। শুরু হল প্রথাগত তালিম। ১৯৪৫ সাল, ইন্ডিয়ান রেলওয়ে আয়োজিত রাজ্যস্তরের এক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন নীলিমা মুখোপাধ্যায়। কীর্তন গাইবেন। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরবাবুর কাছে নানা ধরনের গান শিখলেও, তখনও প্রথাগতভাবে কীর্তন শেখা শুরু হয়নি ওঁর। সেই প্রথম কীর্তন শেখা শুরু হল, গুরু সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সহোদর রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে। 


সে বছরই কলকাতা বেতারে কাজী নজরুল ইসলামের ‘দূরের বন্ধু আছে আমার ঐ গাঙের পারের গাঁয়ে’ গেয়ে অডিশনে পাশ করেন নীলিমা। ১৯৩৭ সালে, এ গান রেকর্ডে গেয়েছিলেন গুরু সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। ওঁর কাছেই ‘দূরের বন্ধু’ শিখেছিলেন নীলিমা মুখোপাধ্যায়। তখন থেকেই, ঠুংরি, ভজন, রাগপ্রধান, পল্লিগীতি, আধুনিক – বিভিন্ন ধরনের গান, বেতারে নিয়মিত পরিবেশন করতেন নীলিমা। গ্রামোফোন রেকর্ড করার সুযোগও আসে তার পরেই। প্রথম রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় ‘প্রীতি মুখোপাধ্যায়’ নামে, হিন্দুস্থান কোম্পানি থেকে। তারপর, স্বনামে পল্লিগীতির রেকর্ড প্রকাশিত হয় এইচএমভি থেকে, ‘প্রথম দেখার ক্ষণে লেগেছে ভাল’ - গিরিন চক্রবর্তীর সুরে।

১৯৪৮ সালে, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায়, ‘সর্বহারা’ ছায়াছবিতে প্রথম নেপথ্যসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীলিমা মুখোপাধ্যায়। না – মুখোপাধ্যায় নন। তখন তিনি নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। তবে, রেকর্ডের কৌতুকাভিনেতা  হিসাবে অল্প পরিচয় থাকলেও, তখনও তিনি চলচ্চিত্রাভিনেতা ‘ভানু’ নন। চাকরি করতেন আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোল বোর্ডে। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রেই প্রিয় ছাত্রী নীলিমার সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ে দেন সিদ্ধেশ্বরবাবু, ১৯৪৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স তখন সতেরো।
স্বামী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে

দ্বিরাগমনের দিন চমক। শ্বশুরবাড়ি এসেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, স্ত্রীকে নিয়ে। সেদিনই বললেন, ‘রাধা ফিল্ম স্টুডিও’ থেকে একটু ঘুরে আসি। এদিকে রাত হয়ে যায়, জামাই ফেরে না। চিন্তিত পরেশ মুখোপাধ্যায় স্টুডিওতে চলে গেলেন জামাইকে খুঁজে আনতে। ‘ভানু’ নাম বলতেই এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন – পরনে ছেঁড়া চটের কাপড়। এই লোকটি কোনওভাবেই তাঁর জামাই হতে পারেন না, নিশ্চিত পরেশবাবু। তখন মেক-আপ ছেড়ে শ্বশুরমশাইকে দেখা দিলেন ছেঁড়া চট পরা লোকটি। হ্যাঁ, ওঁর জামাই-ই বটে। সেই প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছবির নাম, ‘জাগরণ’ – মুক্তিপ্রাপ্ত হয় ১৯৪৭ সালে। তার ঠিক পরের বছর, ওঁর অভিনীত ‘সর্বহারা’ ছবিতে প্রথম শোনা গেল নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। বলা চলে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম চলচ্চিত্রাভিনেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ও নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেপথ্যসঙ্গীতশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ, ঘটল প্রায় একই সময়ে

'সর্বহারা' (১৯৪৮) ছবির পুস্তিকা-প্রচ্ছদ

‘সর্বহারা’ ছবিতে সঙ্গীতপরিবেশনের পর ‘রূপকথা’ (১৯৫০), ‘কবি চন্দ্রাবতী’ (১৯৫২), ‘অদৃশ্য মানুষ’ (১৯৫৩), ‘অ্যাটম বোম’ (১৯৫৪), ‘দুখীর ইমান’ (১৯৫৪), ‘মনের ময়ূর’ (১৯৫৪), ‘ও আমার দেশের মাটি’ (১৯৫৮), ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ (১৯৫৯), ‘কাঞ্চনমূল্য’ (১৯৬১), ‘মহাতীর্থ কালীঘাট’ (১৯৬৪), ইত্যাদি ছবিতে শোনা গেছে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান। 



নির্মলেন্দু চৌধুরীর সুরে, ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবিতে ‘যুগল মিলন দেখ গো, বৃন্দাবন আজ প্রেমে ভেসে যায়’, ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘মননদীর কূলে কূলে’, কিংবা ‘মনের ময়ূর’ ছবিতে সত্যজিৎ মজুমদারের সুরে, দ্বিজেন চৌধুরী ও শ্যামল মিত্রের সহকন্ঠে ‘বল বদর বদর’ প্রভৃতি লোকসুরাশ্রিত গান, নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠদানে মধুময় হয়ে ওঠে।

এইচএমভি'তে, সঙ্গে পবিত্র মিত্র, গীতা দত্ত, অনিমেষ বসু, সুধীন দাশগুপ্ত 

পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে, এইচএমভি ও কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ড বিভিন্ন ধরণের গানে ওঁর ছিল সমান পারদর্শিতা মূলত আটাত্তর-পাক রেকর্ডে, নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ধরা আছে কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, পল্লীগীতি, কান্তগীতি, নজরুলগীতি ও দেশাত্মবোধক গান ছাড়াও, বেশ কিছু অপূর্ব আধুনিক গান, ছড়ার গান ও কৌতুকগীতি 


১৯৫৬ সালের পুজোয়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি ইলিশমাছের ডিম্' সাড়া ফেলে দিয়েছিল যে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে, ১৯৫৮ সালের পুজোয় সে কন্ঠেই শোনা গেলো অপূর্ব শ্যামাসঙ্গীত, 'আমার অশ্রুমোতির মালা' এ হেন শিল্পীই, ১৯৫৫ সালের পুজোয় মাতিয়েছিলেন শ্যামল মিত্রের সুরে 'আতা গাছে তোতাপাখি' ছড়াগানে ভুলবনা, সে সময় ছড়াগানে একচেটিয়া রাজত্ব করছেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় এর কিছু মাস আগেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর 'হাট্টিমাটিমটিম' সে গানের পাশেই স্থান পেয়েছিল নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অপূর্ব ছড়া এইচএমভি, কলম্বিয়া ছাড়াও, মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ওঁর ছড়াগানের রেকর্ড। সে অবশ্য অনেক পরে, ১৯৭৭ সালে। 

কীর্তনের রেকর্ডের স্যাম্পল কপি (১৯৫৬ সাল)

সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়-রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের শিষ্যা নীলিমা দেবী, কীর্তনে পারদর্শিনী হবেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা পঞ্চাশের দশকে গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই কীর্তনে তালিম নিতেন রত্নেশ্বরবাবুর কাছে বেতারে কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি, কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে কীর্তনের রেকর্ডও করেছেন নীলিমা দেবী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের প্রশিক্ষণে 'জিতি কুঞ্জর গতি মন্থর' (চন্দ্রশেখর), 'হ্যাদে হে নিলাজ বঁধু লাজ নাহি বাস' (দ্বিজ চন্ডীদাস), কিংবা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের প্রশিক্ষণে 'ওই রাসমঞ্চ মাঝে' (গোবিন্দদাস), 'ধনি ভেল মুরছিত' (গোবিন্দদাস), প্রভৃতি অপূর্ব গান, কীর্তনে ওঁর পারদর্শিতা প্রমাণ করে  


বেতারে পল্লীগীতি পরিবেশন করেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন নীলিমা দেবী ফলত, ষাটের দশকের গোড়া থেকেই, মূলত নির্মলেন্দু চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে একের পর এক প্রকাশ পেতে থাকে ওঁর কণ্ঠে পল্লীগীতির রেকর্ড 'চল টুসু চল খেলতে যাব' (১৯৬০), 'কে তুমি সুন্দরী কন্যা' - নির্মলেন্দু চৌধুরীর সহকণ্ঠে (১৯৬১), 'রাই জাগো গো জাগো' (১৯৬২), 'মেঘবরণের চরণ যেন' (১৯৬৫), 'জাগো রে জাগো রাধার মদনমোহন' (১৯৬৯), ইত্যাদি গানে, নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠের জাদু বয়ে আনে পল্লীগ্রামের মাটির মিষ্টি গন্ধ

পল্লীগীতির রেকর্ড (১৯৬০ সাল) 

১৯৫৬ সাল। ভূপেন হাজারিকার সুরে ‘এক মেঘের দেশের শ্যামলা মেয়ে’ আর ‘ঘুমভাঙা রদ্দুরে’ রেকর্ড করবেন নীলিমা। দ্বিতীয় গানটির রিহার্সাল চলছে। গানের সঙ্গে একটি অল্পবয়সী নেপালী ছেলের বাঁশী বাজানো শুনে মুগ্ধ শিল্পী। রিহার্সাল শেষ হতে, ছেলেটিকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়ালেন। ছেলেটিও খুশী, অনুপ্রাণিত। কীর্তন-প্রাণ শিল্পী কি আর বাঁশীওয়ালাকে চিনতে ভুল করবেন! সেই বাঁশীওয়ালাই পরবর্তীকালের খ্যাতনামা যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী মনোহারী সিং!



সুদূর ১৯৪৫ সালে নজরুলগীতি গেয়ে বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেছিলেন নীলিমা দেবী গুরু সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন কাজী নজরুলের একান্ত অন্তরঙ্গ ওঁরই সূত্রে, নজরুলজন্মজয়ন্তীতে কবির বসতবাটীতে গিয়ে গান শোনাতেন নীলিমা সে আসরে সিদ্ধেশ্বরবাবু ছাড়াও থাকতেন সত্যেশ্বর মুখোপাধ্যায়, নবকুমার মুখোপাধ্যায় (রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পুত্র) - থাকতেন কাজী নজরুলের পরিবারের সদস্যেরা, যথা প্রমীলা দেবী, কাজী সব্যসাচী, প্রমুখ ১৯৬০ সালে, কলম্বিয়া কোম্পানিতে, কাজী নজরুল রচিত ঝুমুর অঙ্গের 'ঐ রাঙামাটির পথে লো' রেকর্ড করেছিলেন নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
গায়ত্রী বসু, বাঁশরী লাহিড়ী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে  

'সঙ্গীতশ্রী' নামে গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নীলিমা দেবী প্রথম যুগে সেখানে গান শেখাতেন শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রভাতভূষণের মতো শিল্পী এককালে যুক্ত ছিলেন গণনাট্যের সঙ্গীতগোষ্ঠীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল উৎপলা সেন, সাবিত্রী ঘোষ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলা বসু, বাণী ঘোষালের মতো শিল্পীবন্ধুদের সঙ্গে ১৯৭৬ সালে, শ্যামল মিত্র ও গায়ত্রী বসুর সঙ্গে সুদূর আমেরিকায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন নীলিমা দেবী সে যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও নানা কাজের চাপে, এর আগে ভানু-নীলিমার একত্রে খুব দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি, মনে কিছুটা দুঃখ হয়তো ছিল নীলিমা দেবীর আমেরিকা যাত্রার পর ভানু বলেছিলেন - সমস্ত জীবনের না বেড়ানোর আপসোস একবারেই পুষিয়ে দিলাম! স্বামীর সঙ্গে নীলিমা দেবীর শিল্প-সংক্রান্ত বোঝাপড়া ছিল অপূর্ব সঙ্গীতশাস্ত্রে প্রথাগতভাবে শিক্ষিত না হলেও রেওয়াজের সময় ভানুবাবু স্ত্রীকে ইঙ্গিতে ধরিয়ে দিতেন সামান্যতম ত্রুটি পেশাগতভাবে সঙ্গীতপরিবেশনের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে কখনও বাধা তো দেনই নি, উৎসাহিত করেছেন চিরদিন 



১৯৬৬ সালে নজরুলজয়ন্তীর প্রাক্কালে হঠাৎ অনুপকুমার আসেন ভানু-নীলিমার বাড়ি সঙ্গে সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন - তুইও কাল আমাদের সঙ্গে কাজী নজরুলের বাড়ি যাবি নইলে আমার 'ইস্তিরির' সঙ্গে তবলা কে বাজাবে! ভানু-নীলিমা, অনুপকুমারের সঙ্গে কাজী নজরুলের বাড়ি গেলেন রবি ঘোষ, সুমিতা সান্যালও। একইভাবে স্বামীর কাজে নীলিমা দেবী সহযোগিতা করে গেছেন বরাবর আর্থিক অনটনের সময়, যাত্রাদলে গীতিকার-সুরকারদের বেতনসহ নিযুক্ত করা সমস্যার হলে, গায়িকা নীলিমা নেমে পড়লেন গান লেখা, সুর করার কাজে আস্বস্ত হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় পর পর প্রায় আট-নয়টি নাটকে গীতিকার ও সুরকারের ভূমিকা পালন করেন নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনকি স্বামীর অনুপ্রেরণায় ‘জাঁতাকল’ নামে একটি নাটকও রচনা করেন উনি। রবীন্দ্র সারবোর মঞ্চে ‘মহিলা সমিতি’ মঞ্চস্থ করেন সেই নাটক।
নজরুলগীতির অনুষ্ঠান, শিল্পী নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় 

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন ১৯৮৩ সালের ৪ঠা মার্চ
২০১৭ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী, কিছুকালের রোগভোগের পর চলে গেলেন নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বয়স হয়েছিল ৮৭  মননদীর কূলে কূলে ফুল ফুটবেআতাগাছে তোতা - ডালিমে মৌ উড়ে এসে বসবে, যুগলমিলনে বৃন্দাবন ভেসে যাবে প্রেমে, তারই মধ্য দিয়ে পল্লীগ্রামের মেঠো সুর বেজে উঠবে শিল্পীর কণ্ঠে, শোনা যাবে দু-চোখ বেয়ে জল ঝরানো কীর্তন কোনও রসিক শ্রোতা হয়তো ডুব দেবেন নস্টালজিয়ায় - আটাত্তর পাক রেকর্ড বসাবেন পুরোনো গ্রামোফোনে... সেখান থেকে গেয়ে উঠবেন নীলিমা দেবী - জিতি কুঞ্জর গতি মন্থর গমন করল নারী, বংশীবট যাবট তট বনহি বন ফেরি... এ গীতিমধু অশেষ, অনন্ত


2 comments:

  1. অসাধারণ!আবারও আপনাকে ধন‍্যবাদ এমন তথ‍্য-সমৃদ্ধ লেখা পরিবেশনের জন‍্য।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগল। শুভেচ্ছা জানবেন।

    ReplyDelete