Tuesday, 18 July 2017

ভালোবেসে আজি এই রাতে

                                     'সে-যুগের' গান (বাংলা রেকর্ড-গানের ক্ষেত্রে 'সে-যুগ' বলতে আপাত অর্থে যা বোঝায়) শুনে আসছি প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই - রেডিওয়, ক্যাসেটে, টিভিতে। ছোট যখন, তখনও পুজোর প্যান্ডেলে 'সে-যুগের' গান মাঝেমধ্যেই বাজত। শুনতাম। ছোটবেলার ছটফটানি কাটিয়ে যখন একটু স্থির হওয়ার পালা, তখন একটু একটু করে শিল্পীদেরও চিনে নিলাম। গান সম্বন্ধে, শিল্পী সম্বন্ধে একটা ভালো-লাগা মন্দ-লাগার বোধ তৈরী হল। একদম প্রথম লগ্নেই যাঁর গান 'অকারণে' ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তিনি প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।


                                     মনে হত, একটা রহস্য আছে ওঁর কন্ঠে। অনেকের গান শুনে, সহজেই তৃপ্ত হয়েছি - সুর-তাল-লয়-ছন্দ-উচ্চারণ-অভিব্যক্তি সব মিলে সেসব গান অনায়াসে একটা মুগ্ধতা এনেছে, আনন্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শুনে, সেই 'সহজ তৃপ্তি' আসত না  - একটা 'রহস্যময় গভীর'- ডুব দেওয়ার ব্যাপার পেতাম ওঁর গানে। সে রহস্যের কূলকিনারা পেতাম না - সে কারণেই হয়ত আরও শুনতে ইচ্ছে করত - বারবার শুনতে ইচ্ছে করত। শুনতামও - নেশা ধরে গেছিল। আর যখন শুনতাম না, তখনও যেন তানপুরার অনুরণনের মতো, ওঁর গান কানে বেজেই চলত - 'আমার বকুল ফুল কই', 'আঁধার আমার ভালো লাগে', 'প্রদীপ কহিল দখিণা সমীরে', 'ছলকে পড়ে কলকে ফুলে' - আরও কত গান!


                                     আরও অনেকটা পরে, যখন 'অকারণ ভালবাসা'- কারণ অনুসন্ধানে অধীর হল মন, বারবার প্রশ্ন জাগত - কার জন্য গাইছেন প্রতিমা? এই দুর্ভেদ্য রহস্য কেন ওঁর অভিব্যক্তিতে? দুঃখের কথা, আনন্দের কথা, ভালো কথা, বাজে কথা, সবই তো আমরা খুব স্পষ্ট করেই - আর পাঁচজনের বোধগম্য হয়, এমন করেই বলে থাকি। প্রতিমা কী এমন বলেন, যা আপাত কোনো অর্থে পৌঁছে সন্তুষ্টি না দিয়ে, রহস্যের গভীরে নিয়ে যায়? শিল্পী শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে গান, এটাই প্রাথমিকভাবে মনে হত। শিল্পী দুঃখের গান গাইবেন, শ্রোতার চোখ আর্দ্র হয়ে আসবে, আনন্দের গান গাইবেন - শ্রোতা তালে তালে তালি দেবে, এটাই ধারণা ছিল। কিন্তু প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান, সেই ছোট্টবেলাতেই, আমার মনের সবকিছু একেবারে উল্টেপাল্টে দিয়েছিল! কার জন্য গান, প্রতিমা?


                                     যখন টিভিতে প্রথম দেখলাম ওঁকে, রহস্য আরও জটিল হল! প্রথমে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং বাজলো, 'ওই মৌসুমী মন শুধু রং বদলায়', 'আহা না রয়না বাঁধা রয়না' - অনন্য! আমি ততক্ষণে রীতিমত 'চার্জড' হয়ে গেছি। তারপরেই প্রতিমার গান। লাল-কালো শাড়ি, মাঝকপালে সিঁদূরের টিপ, নাকছাবি - সে এক অদ্ভুত চেহারা যেন! গান শুরু হল - কি অবলীলায় গেয়ে চলেছেন, 'কুসুমদোলায় দোলে শ্যামরায়', 'আমার সোনা চাঁদের কণা', 'সাতরঙা এক পাখি', অথচ মুখেচখে কোনও 'এক্সপ্রেশন' নেই, পান-খাওয়া লাল ঠোঁটদুটো শুধু নড়ে চলেছে। চাহনিতে এক অদ্ভুত রহস্য। কী গভীরভাবে আত্মমগ্ন! ততক্ষনে 'চার্জড' আমি, স্থির হয়ে গেছি, সেই মগ্নতার রহস্যময় গভীরে ডুব দিয়েছি।


                                     সবসময় মনে হত, প্রতিমার গানে এক  অন্তহীন খুঁজে চলা আছে।  কিন্তু সে খোঁজা শিল্পীরই - সেখানে আর কারও স্থান নেই। যাঁকে খুঁজে চলে প্রতিমার গান, গান তাঁরই। শ্রোতা সে অনুসন্ধান-দৃশ্যের সাক্ষীমাত্র। এখন তাই মনে হয়, সে জন্যই কি ওঁর গানের এই রহস্যকে আজও আবিষ্কার করতে পারলাম না? সে গান যে আমার উদ্দেশ্যে গাওয়াই নয়! শিল্পী আর তাঁর উদ্দিষ্টের মধ্যে 'আমি' যেন কোথাও নেই!


সীমার মাঝে, অসীম, তুমি
বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাই এত মধুর।।


                                     সেই অসীমের সুর খুঁজতেই কি প্রতিমার গান গাওয়া?





                                    এইচ এম ভি' রেকর্ডের বইতে ওঁর ছবির নিচে কোনও এক বছর ছাপা হল, 'যাঁর প্রত্যেকটি গান সুরের দেবতার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার অঞ্জলির মত উৎসর্গিত, সেই সুকন্ঠী গায়িকা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবারের গান দু'খানিও প্রান ঢেলে গেয়েছেন।'


                                     বড় ভালো লাগে কথাগুলো। এই 'নিবেদন'-এর ভাবটাই যেন প্রধান হয়ে ওঠে, প্রতিমার গানে। তবে শুধু শ্রদ্ধা নয়, তাতে জড়িয়ে থাকে অনন্ত ভালবাসার সুর। এই 'সুরের দেবতা' কে, জানিনা - জানার দরকারও নেই। কিন্তু শ্রদ্ধা, ভালবাসা, নিবেদন আর অশেষ বিশ্বাস মিশে যে ভক্তির ভাবটি স্থাপিত হয়, প্রতিমার সমস্ত সত্তার মধ্যে যেন তারই চিহ্ন।


আর কারো পানে চাহিব না আর,
করিব হে আমি প্রাণ পণ -
তুমি যদি বল এখনি করিব
বিষয়বাসনা বিসর্জন।


                                     যেন এক স্পষ্ট ব্যক্তি 'তুমি'- কাছেই আত্মসমর্পণ। কোনও এক আপাত রহস্যের সঙ্গে তাঁর যেন নিতান্ত ব্যক্তিগত এক সম্পর্ক। তাই কি অমন আকুল স্বরে গেয়ে ওঠেন প্রতিমা, 'দরস বিন দুখন লাগে ন্যান, যবসে তুম বিছুরে প্রভু মোরে কবহুঁ না পায়ো চ্যান'? ওঁর অপলক চোখদুটি যেন তাঁকেই খুঁজে চলেছে। 


উড়িয়া যায় চখুয়ার পঙ্খী বগীক বলে ঠারে।
ওরে তোমার বগা বন্দী হইছে ধল্লা নদীর পারে রে।।
এই কথা শুনিয়া রে বগী দুই পাখা মেলিল।
ওরে ধল্লা নদীর পারে যাইয়া দরশন দিল রে।।
বগাক্ দেখিয়া বগিক কান্দে রে।
বগীক্ দেখিয়া বগা কান্দে রে।।


                                     ভাওয়াইয়া সুরে যখন বগা-বগীর বিচ্ছেদব্যথা ফুটিয়ে তোলেন প্রতিমা, তখন 
যেন সেই চিরন্তন কান্নার সুরই বেজে ওঠে - 'কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না'। মনে যেন হয়, এ কান্নাকে প্রতিমা খুব ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। কখনও আবার 'জীবন নদীর ওপারে' এসে দাঁড়াতে বলেন তাঁর উদ্দিষ্টকে। 'আপনা হারায়ে, নিজে হারা' হয়ে, হতে চান একাকার। সাধ্য-সাধকের সমস্ত দ্বৈততা ঘুচিয়ে এক অদ্বৈত চৈতন্যে হন উপনীত। অদ্বৈত চৈতন্যে যেমন উদ্দিষ্টকে পরম পাওয়া, 'জীবন নদীর ওপারে', তেমন বোধিদীপ্ত সত্তার বলে, খেলাচ্ছলে অদ্বৈতকে বিভক্ত করেই যেন গেয়ে ওঠেন প্রতিমা- 'তোমার দু'চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা' সে বিভক্ত সত্তা 'অদ্বৈতাদপি সুন্দরম্'! কখনও আবার রূপসাগরে অরূপরতনের ঈষৎ ঝলকানি দেখেই যেন গেয়ে ওঠেন, 'আকাশ মোর আলোয় দে' ভরে'


                                     প্রতিমার গানে নিবেদনের ভাবটি এত প্রবল, যে 'ভক্তি' ওঁর গানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। সবধরণের গানকেই যেন উনি ভক্তি দিয়ে স্পর্শ করেন।  সে ভক্তিই ক্ষেত্রান্তরে নানাভাবে প্রতীয়মান হয়।  'চাঁদ বললে ভুল হয়, ফুল বললেও ভুল হয়' গানে বাৎসল্যের ভাবটি যেন এক স্বতন্ত্র মাত্রায় প্রকাশ্য হয়। গানে মায়েরও যেন এক ধরণের আত্মসমর্পনের ছবি ফুটে ওঠে, তাঁর 'ইচ্ছে দিয়ে সৃষ্টি' খুকুর নির্মলতার কাছে। আবার 'কঙ্কাবতীর কাঁকন বাজে'-তে  ভিটেছাড়া সেই মেয়ের সাথে কী পরম মমত্বের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করেন প্রতিমা! কখনো বা গঙ্গার স্রোতে 'মনের প্রদীপটি' ভাসান। সে গঙ্গাই যেন হয়ে ওঠে পরম চাওয়া, যখন, 'নেই কেউ দরদী, ব্যথা বোঝেনা - মায়া-শিকল বাঁধা দুটি পায়ে' এখানেও যেন সখ্যের মধ্য দিয়ে এক রহস্যময় গভীরতায় পৌঁছানোর হাতছানি!


নাও না গো সঙ্গে, মিনতি জানাইলাম।
সেই আলোর দেশে , মিনতি জানাই।।


                                     'আঁধার'-কে ভালোবেসে প্রতিমা বলেন, 'তারা দিয়ে সাজিওনা আমার আকাশ, আঁধার আমার ভালো লাগে' এর মধ্যে প্রত্যাশা আছে -


রাতের গভীরে আজ বঁধুয়ার পরশে
হাজার প্রদীপ যাবে জ্বলে,
বঁধুয়ার পরশেতে জ্বলে যাবে এই রাত
রাগে-অনুরাগে-ভালবাসতে।


                                     কী অনায়াসে আত্মমগ্ন প্রতিমা এই প্রত্যাশার সুরটি ফুটিয়ে তোলেন! আর তার ঠিক পরেই -


জানিনাতো বঁধু ওগো মরণ রয়েছে লেখা,
ভালোবেসে আজি এই রাতে।


                                     এই বাঁধভাঙা আত্মসমর্পণের সুর, একমাত্র প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠেই ফুটে উঠতে পারে! এও তো সেই দ্বিত্বের সমাপ্তি। গান কেন প্রতিমার কন্ঠে এমন অনন্য মাত্রায় প্রকাশ পায়, তা কখনও কখনও ভাবি! জানিনা, এইচএমভি' শারদীয়া পত্রিকার সেই কাঙ্খিত 'সুরের দেবতা'- সঙ্গে পরম মিলনের ছবির জন্যই হয়ত! প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের সঙ্গে (নাকি সত্তার সঙ্গেই?) অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে রহস্য, যে অশেষ খোঁজ, তার এক সম্ভাব্য 'শেষ সীমা'- কোনও ইঙ্গিত যেন পাই, যখন শিল্পী গেয়ে ওঠেন,    


জানিনাতো বঁধু ওগো মরণ রয়েছে লেখা,
ভালোবেসে আজি এই রাতে।



                                     এই ইঙ্গিতই আবার, কোনও এক 'শুরু'-তে পৌঁছে দেয় - 'শেষ নাহি যে'!  

3 comments:

  1. আমিও ছোটবেলা থেকে গান শুনছি। আমাদের কলের গান প্লেয়ার ছিল. সেখানে রেকর্ডার কাছে কান দিয়ে গান শুনতাম। কিছু একটা বুঝতাম না. মনে আছে আঙুরবালা, আব্বাসউদ্দীনের গান ছিল. তারপর আসলো বাড়িতে মারফি রেডিও মনে হয়.বড় চাচার ছেলে সেই এগুলো করতো। লম্বা বাঁশ দিয়ে এন্টেনা লাগানো হলো রেডিও সিগন্যাল ধরার জন্য। তারপর কলের গানটা উধাও হয়ে গেলো। মনে হয় সেই ওটা করো কাছে বেচে দিয়েছে।প্রথমে প্রতিমার গানের মধ্যে যে সব গান শুনি সেটা আমার মনে আছে. যেমন "মনে আগুন জ্বলে," "একটা গান লিখো আমার জন্য", "সাতরঙা এক পাখি", "প্রিয়া হবো ছিল সাধ", "তোমার দেয়া অঙ্গুরীয়" ইত্যাদি। তখন আমাদের ২টা সিটিজেন ট্রান্সিস্টার দিলো govt . একটা ইউনিয়ন কাউন্সিলের জন্য আর একটা আমার বাবার জন্য।(আমার বাবা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিল). আমাদের আড়তের অপার দিকে ছিল মাইকের দোকান . ভদ্রলোক ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে আসা রেফিউজি। সে নতুন রেকর্ড বেরুলেই smugling করে আনতো তার ব্যবসার জন্য। ওখানে রাতদিন বাজাতো নতুন রেকর্ড গুলো। অনুরোধ করলেই যে কোনো গান শোনাতো। ৬৮' এর দিকে "মিছে দোষ দিওনা আর আমায়" আর "আঁধার আমার ভালো লাগে"(হেমন্ত -মুকুল দত্তের) বাজার মাত্ করে দিল. 45s গান দুটো ছিল আমার মনে আছে। ৭৪ সল্ পর্যন্ত অনুরোধের আসরে অনেক গান শুনেছি।তারপর ক্যাসেট ছাড়া আর গান শোনা হয়নি বাইরে থাকার কারণে । এখন ইন্টারনেটের মাদ্ধমে অনেক গান শুনতে পারছি। কত বড় সৌভাগ্য আমাদের। bazlur rahman

    ReplyDelete